নিকোটিন ডিপেনডেন্সি বা নিকোটিন নির্ভরতা কি?

নিকোটিন ডিপেনডেন্সি বা নিকোটিন নির্ভরতা হল নির্দিষ্ট সময় পর পর শরীরে নিকোটিনের চাহিদা বোধ হওয়া এবং এটি বাদ দিতে না পারা। নিকোটিন হল তামাকের রাসায়নিক যা সিগারেট বা ধূমপানের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। নিকোটিন আমাদের মস্তিষ্কে একধরনের আনন্দদায়ক অনুভূতি তৈরি করে, তবে তা সীমিত সময়ের জন্য। ফলে নির্দিষ্ট সময় বা পরিস্থিতিতে আরেকটি সিগারেটের জন্য চাহিদা তৈরি হয়।

একজন ব্যাক্তি যত বেশি ধূমপান করবে, ততো বেশি শরীরে নিকোটিনের প্রতি চাহিদা তৈরি হবে। যখন কেউ ধূমপান ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন তখন এই আসক্তির প্রভাবে মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হবেন। ধূমপান ছেড়ে দেয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি। কিন্তু এটি সহজ নয়, কারণ নিকোটিন ডিপেনডেন্সি বা নিকোটিন নির্ভরতা আপনাকে আবার সিগারেটের কাছে নিয়ে যাবে।

লক্ষণ

প্রতিদিন যে কোনও পরিমাণ তামাক ব্যবহারের ফলেই নিকোটিন নির্ভরতা তৈরি হতে পারে। আপনার নিকোটিন ডিপেনডেন্সি আছে কিনা তা বুঝতে নিচের লক্ষণগুলো খেয়াল করুনঃ

  • ধূমপান ছাড়তে পারছেন না। গুরুত্ব নিয়ে অনেকবার চেষ্টা করেও সিগারেট গ্রহন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবার শুরু করেছেন। ধরে নিন আপনার মধ্যে নিকোটিন ডিপেনডেন্সি বা নিকোটিন নির্ভরতা আছে।
  • সিগারেট ছেড়ে দেয়ার পর শারীরিক এবং মানসিক কিছু সমস্যা, যেমন- ধূমপানের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, উদ্বেগ, বিরক্তি, অস্থিরতা, মনোযোগে অসুবিধা, হতাশা, রুক্ষ মেজাজ, ক্রোধ, অতিরিক্ত ক্ষুধা, অনিদ্রা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি দেখা দিচ্ছে।
  • স্বাস্থ্য সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ধূমপান ছাড়তে পারেননি। ফুসফুস বা হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা গেছে, ডাক্তার ধূমপান নিষেধ করছেন, তবুও আপনি পারেননি।

এসব উপসর্গ নিকোটিন ডিপেনডেন্সি বা নিকোটিন নির্ভরতার লক্ষন।

কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন?

সিগারেট পুরোপুরি ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করেননি এরকম কোন ধূমপায়ী নেই। সবাইই চেষ্টা করে থাকে, কিন্তু বেশিরভাগ সফল হয়না। নিকোটিন নির্ভরতা থেকে মুক্তি পেতে বিশেষ পরিকল্পনা ও চিকিৎসা প্রয়োজন। কারণ কেউ যখন সিগারেট ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করে তখন শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছু সমস্যার উদ্রেক ঘটে।  নিকোটিন তামাকের রাসায়নিক উপাদান, যা একজন ধূমপায়ীকে বার বার তামাক গ্রহনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। সিগারেটে একটি টান নেওয়ার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিকোটিন মস্তিষ্কে পৌঁছায়। আমাদের মস্তিস্কে বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার রয়েছে। নিকোটিনের প্রভাব মস্তিস্কে এসব নিউরোট্রান্সমিটারের একটিভিটি বাড়িয়ে দেয়। এই নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর মধ্যে একটি হল ডোপামিন যা মস্তিস্কে আনন্দ অনুভূতি বাড়ায়। ফলে কেউ যত বেশি ধূমপান করবেন, নিকোটিন তার কাছে ততো ভাল লাগবে। নিকোটিন দ্রুত তার দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে উঠবে এবং অভ্যাস ও অনুভূতির সাথে জড়িয়ে যাবে।

ধূমপানের তাগিদ তৈরি করে যেসব কারণ

  • চা-কফি পান করা বা কর্মক্ষেত্রে বিরতি নেওয়া
  • ফোনে কথা বলা
  • অ্যালকোহল পান করা
  • ড্রাইভিং
  • বন্ধুদের সাথে আড্ডা
  • কোন বিষয়ে দুশ্চিন্তা
  • কাজের চাপ

নিকোটিন নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে এসব ট্রিগারগুলি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং এসব মোকাবেলা করার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।

যেসব কারণে একজন ব্যক্তি ধূমপানের দিকে ঝুঁকে পড়ে

  • বয়স: বেশিরভাগ মানুষ শৈশব বা কিশোর বয়সে ধূমপান শুরু করে। যতো অল্প বয়সে ধূমপান শুরু করা হয়, ততো বেশি আসক্তি তৈরি হয়।
  • জেনেটিক্স: ধূমপান শুরু করা এবং তাতে আসক্তি তৈরি হওয়া অনেকসময় বংশগত প্রভাবেও হয়ে থাকে। দাদা, বাবা ধূমপায়ী থাকলে সন্তানের এতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
  • বন্ধুদের সংসর্গ: ধূমপায়ী বন্ধু, সহপাঠীদের সংস্পর্শ ধূমপানে ঝুঁকে পড়ার উৎসাহ যোগায়।
  • হতাশা বা অন্যান্য মানসিক অসুস্থতা: অনেক গবেষণায় হতাশা এবং ধূমপানের মধ্যে একটি সম্পর্ক দেখা যায়। যাদের হতাশা, সিজোস্ফ্রেনিয়া, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা অন্যান্য ধরণের মানসিক অসুস্থতা রয়েছে তাদের ধূমপায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
  • নেশাদ্রব্যে আসক্তি: যারা অ্যালকোহল এবং অন্যান্য ড্রাগের প্রতি আসক্ত তাদের ধূমপায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

নিকোটিন ডিপেনডেন্সি বা নিকোটিন নির্ভরতার কুফল

  • তামাকের ধোঁয়ায় ৬০ টিরও বেশি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক এবং আরও অনেক ক্ষতিকারক পদার্থ রয়েছে। অধূমপায়ীদের চেয়ে সিগারেটে আসক্ত ব্যক্তির বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ফুসফুসের ক্যান্সার এবং ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের অন্যতম কারণ দীর্ঘমেয়াদি ধূমপানে আসক্তি। এছাড়াও ধূমপান অন্যান্য বিভিন্ন ক্যান্সার যেমন মুখ, গলা, খাদ্যনালী, স্বরযন্ত্র, মূত্রাশয়, অগ্ন্যাশয়, কিডনি, জরায়ু এবং কিছু ধরণের লিউকেমিয়া ইত্যাদির ঝুঁকি বাড়ায়। সামগ্রিকভাবে, ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩০% ঘটে কেবল ধূমপানের কারণে।
  • ধূমপান হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক সহ হৃদযন্ত্র এবং রক্তনালীর(কার্ডিওভাসকুলার) বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। যারা হার্টের এবং উচ্চরক্তচাপের এবং ডায়াবেটিসের রোগী, ধূমপানের ফলে এসব রোগ আরও জটিল আকার ধারন করে।
  • কিডনি রোগীদের জন্য ধূমপান অত্যন্ত ক্ষতিকর।
  • ধূমপানের ফলে চোখের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে, চোখে ছানি পড়তে পারে এবং ম্যাকুলার ডিজেনারেশন হয়ে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়।
  • ধূমপান মহিলাদের গর্ভধারণক্ষমতা কমায় এবং পুরুষদের পুরুষত্বহীনতার ঝুঁকি বাড়ায়।
  • ধূমপায়ীদের শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন সংক্রমণ, যেমনঃ সর্দি, ফ্লু এবং ব্রঙ্কাইটিস হবার সম্ভাবনা বেশি।
  • ধূমপানের ফলে মাড়িতে ইনফেকশন হতে পারে। মাড়ি ফুলে যেতে পারে। দাঁতের গুনগত মান কমে যাওয়া ছাড়াও ধূমপায়ীদের দাঁতে স্থায়ী দাগ সৃষ্টি হয়।
  • ধূমপান আপনার চারপাশের লোকদের জন্যও স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।

প্রতিরোধ

নিকোটিন ডিপেনডেন্সি বা নিকোটিন নির্ভরতা প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হল ধূমপানের কুফল নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। যার সিগারেটে আসক্তি আছে ধূমপানের স্বাস্থ্যঝুঁকি বুঝতে পারলে তিনি এটি ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন। বাচ্চাদের ধূমপান থেকে বিরত রাখার সর্বোত্তম উপায় হল নিজে ধূমপান না করা। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বাচ্চাদের বাবা-মা ধূমপান করেন না তাদের সন্তানদের ধূমপান করার সম্ভাবনা অনেক কম।