বুড়ো হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা? চলুন জেনে নিই বার্ধক্যের কারণ।

বয়স বেড়ে যাচ্ছে? বুড়ো হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন? দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বার্ধক্য মানুষের জীবনে এমন এক বাস্তবতা যা আমরা সবাই অনুভব করি। বুড়ো হওয়া থেকে পালিয়ে বেড়ানো যায়না। বয়সের সাথে সাথে আসা পরিবর্তনগুলো যেমন, স্মৃতিশক্তি কমা, চামড়া কুঁচকে যাওয়া, পেশী ও শক্তি হারানো ইত্যাদির একটি তালিকা তৈরি করা সহজ। কিন্তু তার আগে বার্ধক্য কি, বুড়ো হওয়ার কারণ এবং কিভাবে বার্ধক্য আসাকে শিথিল করা যায় এসব নিয়ে আমাদের জানা প্রয়োজন।

বুড়ো হওয়া কি?

বার্ধক্য বা বুড়ো হওয়া একটি মন্থর জৈবিক ঘটনা যা সময়ের সাথে আনুক্রমিক গতিতে দৈহিক অবক্ষয় ঘটায় এবং যার অবধারিত পরিণতি হল মৃত্যু। এটি একটি অবশ্যম্ভাবী জৈবিক বাস্তবতা এবং এর একটা নিজস্ব গতি রয়েছে। বার্ধক্যকে প্রতিরোধ করার কোন উপায় কেউ কোনদিন খুঁজে পায়নি।

বার্ধক্যের কারন কি?

বার্ধক্য একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে জীবদেহে এর গতি জিনগত প্রভাব ও জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত। বার্ধক্যের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-

সেলুলার এজিং

একটি কোষ কতবার বিভাজিত হয়ে প্রতিলিপি তৈরি করেছে তার সংখ্যার উপর ভিত্তি করে কোষের বয়স নির্ধারণ করা হয়। একটি কোষ প্রায় ৫০ বার বিভাজিত হয়ে প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। ফ্রি রেডিক্যাল এবং অন্যান্য কারনে কোষের যত বেশি ক্ষতি হয়, ততই কোষের প্রতিলিপি করার প্রয়োজন হয়। আর এভাবে কোষের যতো বেশি প্রতিলিপি হয় ততই তাড়াতাড়ি বার্ধক্য আসে।

হরমোনের প্রভাব

হরমোন বার্ধক্যের পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। শৈশবের বৃদ্ধি এবং কিশোর-কিশোরীদের পরিপক্কতার সময়ের অনেক কিছুই হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। হরমোন নিঃসরণের মাত্রা জীবনের বিভিন্ন সময়ে ওঠানামা করে। বয়ঃসন্ধিকালের তৈলাক্ত ত্বকের ব্রণ এবং বয়স বাড়ার সাথে শুষ্ক ত্বক, মহিলাদের মেনোপজ- সবই হরমোনের প্রভাবে ঘটে।

বাহ্যিক প্রভাব

বাহ্যিক বিভিন্ন কারন যেমন টক্সিন, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি, ক্ষতিকর খাদ্য, দূষণ, এবং ধোঁয়ার সংস্পর্শ শরীরের উপর প্রভাব ফেলে। সময়ের সাথে সাথে এইসব উপাদানগুলি টিস্যুর ক্ষতি সাধন করতে পারে।  ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন কোষের এবং টিস্যুর মেরামত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রক্ষণাবেক্ষণ এসব বার্ধক্যের ক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।

মেটাবলিক এজিং

যত দিন যায়, আমাদের শরীর ততো খাদ্যকে শক্তিতে রুপান্তরিত করে চলে। এই শক্তি তৈরির প্রক্রিয়ায় শরীরে প্রচুর বিপাকীয় বজ্য উৎপাদিত হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে এগুলো আমাদের শরীরের ক্ষতিসাধন করে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে উপবাসের মতো অভ্যাসের মাধ্যমে বিপাকীয় প্রক্রিয়ার লাগাম টেনে ধরলে মানুষের বার্ধক্যের গতি কমিয়ে দিতে পারে।

জিনগত প্রভাব

বার্ধক্যের সাথে বংশগতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যাদের পিতা-মাতা, দাদা-দাদী বেশি আয়ু পান তাদের বার্ধক্য দেরিতে আসে। আবার অনেকে অল্পতেই বুড়ো হয়ে যান জিনগত প্রভাবের কারণে।

বার্ধক্য বৈষম্য করে না

বার্ধক্য অনিবার্য বাস্তবতা। বার্ধক্য প্রক্রিয়া কোন বৈষম্য করে না। জন্মের সাথে সাথেই এটা সকল জীবের শরীরেই শুরু হয়, এবং সময়ের সাথে সাথে তা শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে প্রভাবিত করে।

উদাহরণস্বরূপ, যখন একজন ব্যক্তির বয়স ৩০ বছর হয় তখনই তার ফুসফুসের টিস্যু স্থিতিশীলতা হারায়। তার পাঁজরের খাঁচার চারপাশের মাংসপেশী দুর্বল হয়ে পড়ে। একইসাথে তার ফুসফুসের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। তার পরিপাক এনজাইম উৎপাদন কমে যায় যা শরীরে পুষ্টির প্রবাহকে কমিয়ে দেয়।

তখন থেকেই হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীতে চর্বি জমতে শুরু করে এবং প্রকোষ্ঠগুলো ইলাস্টিসিটি হারাতে শুরু করে। এর ফলে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস হয় অথবা ধমনী শক্ত হয়ে যায়। মহিলাদের মধ্যে যোনিপথের পিচ্ছিল তরল উৎপাদন হ্রাস পায় এবং টিস্যু কমে যায়। পুরুষদের বেলায় মুত্রথলি বড় হয়ে যেতে পারে এবং শুক্রাণু উৎপাদন কমে যায়।

বার্ধক্যের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব?

যেমনটা আগে বলা হয়েছেঃ বার্ধক্য এড়ানো যাবে না। কথা মোটেও মিথ্যা নয়, কিন্তু আপনি জীবনযাত্রায় এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন যা বায়োলজিক্যাল ঘড়িকে মন্থর করে দিতে পারে। ফলে আপনি বুড়ো হবেন ঠিকই, কিন্তু আরেকটু বেশী সময় নিয়ে।

বিশুদ্ধ খাবার খান

বিগত কয়েক দশক যাবত প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। অতিরিক্ত চিনি, লবণ এবং চর্বি গ্রহন আমাদের শরীরে বিপর্যয় ডেকে আনছে। এর ফলে বিভিন্ন কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ এবং উচ্চ রক্তচাপ সহ অনেক গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাই যত সম্ভব প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এড়িয়ে চলে নিজের উপকার করুন। এ বিষয়ে একটি ফর্মুলা হল যে জিনিস খাওয়ার জন্য কোন প্যাকেট বা মোড়ক খুলতে হয়, তাহলে তা আপনার খাওয়া উচিত নয়। তবে ফলের বিষয় অবশ্য আলাদা। তবুও যদি খেতেই হয় প্যাকেটের লেবেল পড়ুন এবং কম চিনি ও ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। সাদা স্টার্চ, ফলমূল, শাকসবজি, আঁশযুক্ত খাবার এবং লো ডেনসিটি প্রোটিন খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন।

ধূমপান করবেন না

আপনি যদি ধূমপায়ী হন, তবে সম্ভবত তা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু হাল ছাড়বেন না। ধূমপান ত্যাগ করলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়, এবং আপনার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ব্যাপকভাবে কমে যায়। গবেষণায় পাওয়া গেছে ধূমপায়ীরা তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যায়।

ব্যায়াম

আপনি হয়তো দিনে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৫ দিন ব্যায়াম করতে পারবেন না। কিন্তু সুখবর হল যে দিনে মাত্র ১৫ মিনিট মাঝারি শারীরিক পরিশ্রমেও শরীর ভেঙ্গে যাওয়া রোধ করতে পারে। হাঁটুন, সাইকেল চালান অথবা ফিটনেস ক্লাসে অংশ নিন, কিছু না করার চেয়ে কিছু করা ভালো। যারা নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করেন, বয়স তাদের বুড়ো করতে পারেনা।

সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিন

সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশ নেয়া আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে উজ্জীবিত রাখে। এটি দীর্ঘায়ু পাওয়ার জন্য খুবই কার্যকরী। সমাজের অন্যদের সাথে ভাল ও সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখুন। আপনি যাদের ভালোবাসেন তাদের সাথে ভালো যোগাযোগ রাখুন। নতুন নতুন মানুষদের সাথে পরিচিত হবার আগ্রহ বজায় রাখুন।

পর্যাপ্ত ঘুমান

“মারা যাওয়ার পর আপনি চিরকাল ঘুমাবেন, এখন দৌড়ান” এই কথার গুরুত্ব দিবেন না যেন! আপনার শরীরের পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। ঘুমকে যে চোখেই দেখেন না কেন, এটা লাগবেই। প্রতি রাতে পর্যাপ্ত ঘুম আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে দেবে। আপনার মানসিক চাপের মাত্রা কমানোয় ঘুম বড় ওষুধ। পর্যাপ্ত ঘুম না পেলে বার্ধক্যের গতি বেড়ে যায়।

চাপ নিবেন না

মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা এবং রাগ ধরে রাখা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর হতে পারে। আপনি যদি মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করেন, তাহলে নিজেরই বড় উপকার করছেন। চাপমুক্ত থাকুন, ধর্মীও পথে থাকুন, বার্ধক্য সহজে কাবু করবেনা আপনাকে।